যুবকটির বাঁ হাত কাপড়ে পেঁচানো। পুলিশ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে।
যেদিকে যাচ্ছে, পুলিশও সেখানেই চলছে। গ্রেফতার করছে না। কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। তার চালচলনের ওপর নির্ভর করে আছে পুলিশ। হয়তো এই চলাফেরার মধ্যেই কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পুলিশ তার পিছু নিলেও ঘুণাক্ষরে কখনো টের পায়নি যুবকটি। এক বিকালে যুবকটি গেল ডাক্তারের চেম্বারে। বাইরে অপেক্ষায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে গেল যুবকটি।
হাতে নতুন ব্যান্ডেজ। এবার সেই পুলিশের কর্মকর্তা ঢুকে পড়লেন ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারের কাছে প্রশ্ন রাখলেন ওই যুবক সম্পর্কে। ডাক্তার বললেন, ‘আমি নিজেই যেতাম পুলিশ স্টেশনে। আপনি এসে ভালোই করেছেন। ’ নড়েচড়ে বসলেন পুলিশ কর্মকর্তা। হয়তো কিছু একটা মিলবে! ডাক্তার বলতে লাগলেন, যে যুবকটি এসেছিল, তার বাঁ হাতে বড় একটি ক্ষত রয়েছে। যুবকটি তাকে কুকুরে কামড়েছে বলে জানালেও সন্দেহ আছে। এটি মানুষের কামড়ের দাগ হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তাটি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। বেশ কদিন তার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে তার সব আস্তানাই চেনা হয়ে গেছে। এমন এক আস্তানায় অপেক্ষায় পুলিশ কর্মকর্তা। এবার একা নন, পুরো ফোর্স নিয়ে। যুবকটি সেখান থেকে বেরোনোর পরই পুলিশ তাকে পাকড়াও করে। হাতের ক্ষতটি কীসের? এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় যুবকটি। যুবকটি ভাবে, টের পেয়ে গেল নাকি! পুলিশও কিন্তু তখন নিশ্চিত নয়। তবে সেই ক্ষতটি সামনে রেখেই পুলিশ এগোচ্ছে। কিন্তু কুকুরে কামড়েছে— বলেই যাচ্ছে যুবকটি। জেরার মুখে একপর্যায়ে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। যে তথ্যের জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে চষে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সেই তথ্য জেনেও পুলিশ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। হতবাক তারা। বলে কী? নিখোঁজ হওয়া সেই নীহার বানু নেই! কোনো ধরনের সন্দেহ এড়াতে আবারও প্রশ্ন রাখে পুলিশ। একই জবাব আসে যুবকটির কাছ থেকে। ফাঁস হয় সেই লোমহর্ষক ঘটনা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বাইরে যে হত্যাকাণ্ড প্রথম আলোড়ন তুলেছিল সারা দেশ ও দেশের মানুষের মাঝে— তা হলো এই নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। উত্তর জনপদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী নীহার বানুকে হত্যা করা হয়েছিল নির্মম নির্যাতনের পর। তার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল একটি বাড়ির আঙিনায়। প্রায় ছয় মাস পর মাটি খুঁড়ে সেখান থেকে কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়।
প্রাণ বাঁচাতে নীহার বানু কতই না চেষ্টা করেছিলেন। হাত-পা ছুড়ছিলেন। শেষমেশ এক ঘাতকের হাতে কামড় পর্যন্ত দিয়েছিলেন। শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁচতে পারেননি। মৃত্যুর আগমুহূর্তে রেখে যাওয়া নীহার বানুর সেই চিহ্নটি একসময় তার মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ জানতে পারে, তাকে তার সহপাঠী জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু নীহার বিয়েতে অসম্মতি জানান। ক্ষুব্ধ সহপাঠী ও সহপাঠীর বন্ধুরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৬-এ ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শহরের মীনা মঞ্জিল নামের একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নীহারকে নির্যাতন করে। পরে তারই শাড়ি দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রেফতার হওয়া যুবকটির নাম সেতু। সেতুর বন্ধু বাবু বিয়ে করতে চেয়েছিল নীহার বানুকে। নীহার বানু ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী। নিখোঁজের সাড়ে পাঁচ মাস পর উদ্ধার করা হয় তার লাশ, মানে কঙ্কাল। ৪১ বছর আগে নীহার বানু হত্যাকাণ্ড আলোড়ন তুলেছিল সারা দেশে। সুন্দরী নীহার বানুকে তার সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবু বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। রাজি হননি নীহার। এতে ক্রুদ্ধ হন বাবু। একদিন বাবু ও তার বন্ধু সেতু, মিন্টুসহ কয়েকজন মিলে ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শহরের মীনা মঞ্জিল নামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান নীহারকে। সেখানে তারই শাড়ি দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় নীহারকে।
দেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাহিনী প্রকাশিত হলে আঁতকে ওঠে বাংলাদেশ। প্রতিবাদে মুখর হন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তারা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে মিছিল-মিটিং করেন। খুনিদের ছবিসহ পোস্টার ছাপিয়ে ফাঁসির দাবি জানানো হয়। কিন্তু এ ঘটনার মূল আসামি বাবুসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন আজও পলাতক। রটনা আছে, ঘটনার পর তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে একজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও পরবর্তীতে স্টাফ রিপোর্টার আহমেদ শফিউদ্দিন হত্যাকাণ্ড প্রকাশ পাওয়া থেকে বিচারকাজ পর্যন্ত সব দেখেছিলেন। যোগাযোগ করা হলে সিনিয়র এই সাংবাদিক জানান, ‘তখন দেশে এত পত্রিকা-মিডিয়া ছিল না। যে কটা ছিল সেগুলো প্রতিদিন বিচার কার্যক্রমের খবর খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। বিচিত্রার নীহার বানু সংখ্যাটি একাধিকবার মুদ্রণ করা হয়। ’ সিনিয়র এই সাংবাদিক জানিয়েছেন নীহার বানু হত্যার নানা তথ্য।
ভার্সিটি থেকে না ফেরা : ২৭ জানুয়ারি, ১৯৭৬। বাসা থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস চেপে ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে যান নীহার বানু। সন্ধ্যা নামার পরও মেয়েটি বাসায় ফিরে না আসায় বিধবা মায়ের মনে দুশ্চিন্তা। মা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ভাবছেন বড় মেয়েটি বাসায় ফিরে এলেও তো খোঁজাখুঁজি করতে পারত! পেশায় চিকিৎসক বড় মেয়ে বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর থেকেই সংসারটা (মা, পাঁচ বোন আর এক ভাই) টেনে নিয়ে চলছেন। সন্ধ্যা কেটে রাতের আঁধার বাড়তে থাকল, কিন্তু মেয়ে তখনো ফিরলেন না। অজানা আশঙ্কায় মায়ের মন ভারী হতে থাকল। তিনি আর স্থির থাকতে পারছেন না। ঘরের সদর দরজা খুলে গভীর শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিকেল কলেজ থেকে ডিউটি শেষে বাড়ি ফেরেন বড় মেয়ে। মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়েই উত্কণ্ঠিত মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘নীহার তো এখনো ফিরল না রে!’ সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বড় বোন শহরে থেকে ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করেন এমন ছাত্রছাত্রীদের বাসায়। একে একে খোঁজ চলে সহপাঠী, ইয়ারমেটদের বাসায়, অন্য ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের বাসায়, তারপর শহরে বসবাসরত পরিচিত শিক্ষকদের বাসায়। সব শেষে নিকটবর্তী থানা ও হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও নেই নীহার বানু। ভোরের অপেক্ষায় পুরো পরিবার। শঙ্কা, উত্কণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতায় ভারাক্রান্ত দীর্ঘ রাত যেন আর শেষ হতে চায় না। ’৭১-এ যেদিন পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাবাকে ধরে নিয়ে যায় সেদিনের মতো দমবন্ধ করা দুর্বিষহ দীর্ঘ রাত এই পরিবারকে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার পাড়ি দিতে হচ্ছে। পরদিন আশা-নিরাশার দোলাচলে পরিবারের সদস্যরা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, খোঁজ করা হলো ক্লাসে, মেয়েদের হলে; কথা হলো বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের সঙ্গে। খোঁজাখুঁজির সংক্ষিপ্তসার হলো— আগের দিন সকালে নীহার বাসে বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছেন কিন্তু বিকালে বাসে ফেরেননি। সহপাঠীরা বললেন, নীহার ক্লাসে ছিলেন, হাজিরা খাতা দেখে শিক্ষকরা তার ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করলেন। কেউ কেউ বললেন, ক্লাস শেষে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে এক সহপাঠী ছাত্রের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বললেন, দুপুরের দিকে তাকে রিকশায় শহরের দিকে যেতে দেখা গেছে। এই ছিল তার সম্পর্কে সর্বশেষ খবর। শহীদ পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সেই মেয়েটি আর কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে তার ছায়া ফেলে ক্লাস করতে আর্টস বিল্ডিংয়ে যাননি। অথবা ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে শহরে ফিরে বড় রাস্তার মোড়ে নেমে গলির পথ ধরে হেঁটে হেঁটে বাসায় মা আর ভাইবোনদের কাছে ফেরেননি। তার স্বজনরা তাকে আর কোনো দিন জীবিত ফিরে পাননি। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর সে বছরের জুনে শহরের এক বাড়ির আঙিনা খুঁড়ে তার অস্থিমজ্জাহীন কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। এদিকে নীহার বানু নিখোঁজের পর তার সহপাঠী বাবুকেও দেখা যাচ্ছিল না ক্যাম্পাসে। বাবু তাকে একতরফা ভালোবাসতেন। তাই অনেকের ধারণা ছিল, হয়তো তারা একসঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু নিখোঁজের তিন দিন পর বাবুকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়। বাবুর বন্ধু মিন্টুর দেখা মেলে ক্যাম্পাসে। মিন্টুর সঙ্গে নীহার বানুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলে মিন্টু মাটির দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার এই পরিবর্তনে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। পুলিশ তাকে পাকড়াও করে। অন্যদিকে চিকিৎসা নিতে যাওয়া সেতুও পুলিশের কাছে ধরা। সেতুর কাছ থেকে সব তথ্য পায় পুলিশ। তার স্বীকারোক্তিতে লাশ উদ্ধার হয়। নীহার বানুর সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে প্রাণ রক্ষায় কামড় দিয়েছিলেন নীহার বানু। তাতে সেতুর হাতে ক্ষত হয়েছিল। চিকিৎসা না করানোয় ক্ষতটি বড় হয়ে গিয়েছিল। দেশে তখন সামরিক শাসন। বগুড়ায় স্থাপিত দেশের উত্তরাঞ্চলের বিশেষ সামরিক আইন-আদালতে বিচার হলো। মূল আসামিসহ দুজনের অনুপস্থিতিতে বিচার হলো। পলাতক দুজনসহ তিনজনের ফাঁসির আদেশ হয়, আর অন্য একজনের হয় কয়েক বছর মেয়াদি সশ্রম কারাদণ্ড।
বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭
নীহার বানুর সেই চিহ্নে ধরা পড়ে খুনি
Tags
# গোয়েন্দা কাহিনী
# মির্জা মেহেদী তমাল
About Unknown
মির্জা মেহেদী তমাল
লেবেলসমূহ:
গোয়েন্দা কাহিনী,
মির্জা মেহেদী তমাল
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Post Top Ad
Author Details
গল্প পড়তে বা শুনতে কে না ভালোবাসে,সেই ছোট্ট বেলায় দাদির কোলে,নানির কোলে, বা অন্য কারো কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বা চোখ কান খাড়া করে, বৃষ্টি বা শীতের রাতে খাতা মুরি দিয়ে অথবা চাঁদনি রাতে উঠোনে বা ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প কিচ্ছা শুনেনি এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
HELLO! VISITOR