অঘ্রানে বিলের ধান কাটা শেষ।
খালি ধু ধু মাঠ চারিদিকে। অহি বাড়িতে নেই। উঠোনে খড়ের গাদার উপর বসে আছে পরী। দাদীমা যয়নাব বেগম দুপুরের রোদটা গায়ে মাখার জন্য খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে বসেছে। পরীকে কাছে ডেকে বলল- ‘আয় আমার কোলে আয়। মাথাড়া একটু আঁচড়াইয়া দেই। মাথা ভর্তি উকুন। সারাক্ষণ মাথা চুলকাইতে থাকস। অহন বড় হইতাছস। বুদ্ধি হইতাছে। সাবধানে পা ফেলন লাগবো।
যয়নাব বিবির গায়ে উলের চাদর। দুপুরের রোদটা বড় মিষ্টি লাগছে। এবার শীতটাও বেশ পড়ছে। এরকম হাড় কাঁপানো শীতে বয়স্ক লোকদের টিকে থাকাটাও মুশকিল। পরী একা বসে পুতুল খেলছিল। অহিটা থাকলে ভালো হতো। সারাক্ষণ খুনসুটি লেগে থাকত। মায়ের পুরানো শাড়ীর পাড় দিয়ে শাড়ী পরিয়ে দিয়েছে পুতুলের গায়ে। আর একটা পুতুলকে সাজিয়েছে বর। একটা কাগজের বাক্সে কাপড় বিছিয়ে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়েছে। এবার বিয়ে হবে। বাক্সের উপর আর একটা কাপড় মুড়ে দিয়ে বলল, ব্যাস এবার পুতুল বিয়া হইবো। ও নানী ল’ এইবার বরযাত্রী যায়। কাগজের বাক্সটা হাতে করে নিয়ে নানীর পাশে বসল পরী। খাড়াও এবার সুতা দিয়া বাধঁন লাগবো।
অহির নাটাইয়ের সাথে অনেক সুতো। সব মাঞ্জা দেওয়া। ঘুড়িটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে খুঁজে পাচ্ছেনা। নাটাইটাও লুকিয়ে রেখেছে। অহি থাকলে ঘরের চালার সাথে গুঁজে রাখে। পরী খুঁজছে। কখনও রান্নাঘরে, কখনও ঘরের চালায়। গোয়াল ঘরের ওদিকটায় ঘুরে এসেছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। অহির বুদ্ধি আছে। যাওয়ার সময় মাকে বলে গিয়েছে, ‘ও মা ঘুড়ি কই রাখছি, কাউরে কি কন্তু কইবা না। আমি আইসা ঘুড়ি উড়ামু। দেখছ না বিল গুলান কেমন শুকাইয়া গেছে। এই বিলে দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া ঘুড়ি উড়াইতে যা মজা! চাচার লগে বেশিদিন থাকুম না। আইয়া পরুম।
অহি লুকোচুরি খেলায়ও বিচ্ছু। উঠোন ভর্তি খড়ের গাদার মধ্যে লুকোচুরি খেললে কারও সাধ্য নেই খুঁজে বার করবে। খড়ের স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকে। নাটাইটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোথায় খুঁজবে পরী? সারা উঠোন ভর্তি খড় আর খড়ের গাদা। সারা বছরের গরুর খাবার।
আজ হাট বার। রহমত মিয়া দুপুরের খাওয়া সেরে শুকনো খড়ের উপর একটা কাঁথা বিছিয়ে একটু জিরিয়ে নিল। পরীর মাকে বাজারের হাতাটা দিতে বলল। সুফিয়া বেগম হাতাটা দিয়ে বলল, অহনও তিনটা বাজে নাই। এত তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়া কি করবা। একটু জিরাইয়া লও।
- না পরীর মা। তাড়াতাড়ি বাজারটা সাইরা আসি। বেগুন আর মরিচ ক্ষেতে চাষ দেওয়া হইয়া গেছে। দেখি ভালা থাইকা বেগুন মরিচের চারা পাইলে নিয়া আসুম। মাঘের পইলা না লাগাইলে ফলনড়া ভালা হইবো না। অহিটা বাড়িতে নাই। থাইকলে ভালা হইতো। কাজে কামে সাহায্য হইত। আমাগো শহীদটাও কেমন। এতদিন পর ভাইপোরে কাছে পাইয়া আইসতেও দিতাছে না। দেখি, পোস্ট মাস্টারকে দিয়া একখান চিঠি লিইখা পাঠাইয়া দিমুনে।
আমার পরী মা এত হন্যে হয়ে কি খুঁজছে? এদিক ওদিক পরীকে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞাসা করল রহমত।
- একটু সুতা খুঁজতাছি বা’জান। ভাইয়ার নাটাইটা খুঁইজা পাইতাছি না।
- তুই কই পাবি মা। কোথায়ও লুকাইয়া রাখছে হয়তো। তোর মার’থন একটু চাইয়া নে।
- না বা’জান। অহি আমার পুতুল চুরি করছে। আমি অর নাটাইটা লুকাইয়া রাখুম।
তোরা দুই ভাই বইন। সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি কইরা থাকস। আবার কাউকে ছাড়া কেউ থাকতেও পারস না। অহন তো অহি নাই। চাচার লগে ঢাকায় গেছে। আইলে, তহন ঝগড়া করিস। অহন সুতা কি জন্য লাগবো ক’অ।
- আমি পুতুলের কাপড় পড়ামু।
- ও পরীর মা, আমাগো পরীরে একটু সুতা দেও।
সুফিয়া বেগম মুচকি হাসে। গোয়াল ঘর থেকে উঁচু গলায় বলল, আমি কালির দুধ দোয়াইতেছি। আইসা দিমুনে। পরীরে কও আমারে একটু ভালা তেলের বোতলটা দিতে। বাটগুলান খসখসে হইয়া গেছে। আর কি যে হইলো কালিটার। খালি লাথি মারে।
পরী শষ্য তেলের বোতলটা মাকে দিয়ে বলে, মা একটু সুতা দেও। আমি পুতুলের কাপড় পরাইতে পারতাছি না। খালি খুইলা যাইতাছে। সুতা দিয়া বাঁধন লাগবো। সুফিয়া বেগম দুই হাতের তালুতে একটু শষ্য তেল মেখে নেয়। দুই হাঁটুর মাঝখানে বালতিটা চেপে ধরে ওলানে তা দিতে দিতে বলে, তুই একটু কালিটার গলায় হাত বুলাইয়া দে তো মা। কালিটা বড় বেয়ারা হইয়া গেছে। পরী কালির গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কালি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর শিং নাড়াচ্ছে না। পরীর আদর পেয়েছে। একটু দূরে খুঁটির সাথে বাছুরটা বাঁধা। বাছুরটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কালি।
বিকালের দুধটুকু গোয়ালাকে দেয় না। বাছুরও বড় হচ্ছে। দুধও কমে আসছে। রহমতের বারণ আছে। ‘আগে আমাগো পোলা মাইয়া খাইয়া বাঁচলে তারপর গোয়ালারে দিবা। দুধ হইলো ভালা জিনিষ। মাথার ঘিলু বাড়ে। বুদ্ধি-শুদ্ধিও বাড়ে’। অহির খুব পছন্দ দুধের কড়াইটা। কড়াইতে লেগে থাকা ঘন দুধের ছানাটা চামচ দিয়ে চেঁচে খেতে খুব ভালোবাসে। মাঝে মধ্যে ক’টা মুড়ি দিয়ে মেখে নেয়। এই নিয়েও এক পশলা হয়ে যায় ভাই বোনের ঝগড়া। পরী অভিযোগ করে অহি ছেলে বলে শুধু সে-ই ছানা খেতে পারে। পরীকে সেভাবে খেতে দেয় না। এখন অহি নেয়। ভালোই হয়েছে। দুধের কড়াইটা পরী একাই চেটেপুটে খাচ্ছে।
বাজারের আগেই পোস্ট অফিসটা। এক কামড়ার বেড়ার ঘর। গাছের খুঁটি। একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। আশপাশে পাঁচ গ্রাম মিলে এই একটা পোস্ট অফিস। মানুষজনের আনাগোনার কমতি নেই। আশেপাশের প্রায় সব মানুষগুলোকে ডাক পিয়নের চেনা। আজ হাটে বসে চিঠি বিলি করবে। তাই ডাক পিয়ন আগে ভাগে রমজানের দোকানে গিয়ে বসেছে। তাতে কেউ কেউ দু’ চার আনা বখশিষ দেয়। আবার কেউ চা ও পান-বিড়ি খাইয়ে চিঠিটা পরিয়ে নেয়। কোন কোন সময় চিঠি লেখার কাজটাও করে। তবে পোস্ট মাস্টার বিভূতি বাবুর হাতের লেখাটা সুন্দর। গুছিয়ে লিখতে পারে বলে অনেকে তার কাছে আসে। বিনিময়ে দু’ এক টাকা দিলে খুশী হয়। না দিলেও খুশী মনে মেনে নেয়।
বিভূতি বাবু বসে আছেন চেয়ারে। চেয়ারের একটা পা ভাঙ্গা। গাছের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা। রহমতকে বাজারের হাতা নিয়ে ডুকতে দেখে বলল -কী ব্যাপার রহমত মিয়া। আজ যে বড় সকাল সকাল হাটে যাইতাছ। মেহমান আইবো বুঝি।
- না গো বাবু। আমাগো শহীদের কোন চিঠিপত্তর আছে?
- না। কেন শহীদের কি হইছে। এই সেদিন না আইলো।
- কিছু হয় নাই। যাওনের সময় বলল অহির পরীক্ষা তো শেষ। আমার লগে কয়দিন ঢাকায় বেড়াইয়া আসুক। অহিতো মহা খুশী। চাচার লাগে যাইবোই। আর মানা করি কেমনে।
- ভালা করছ রহমত মিয়া। পোলাপানগুলা দেশ-বিদেশ ঘুরলে জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ে। নানান কিছু দেখে। নানান কিছু শিখে। এতে পথ চলতে সুবিধা হয়।
- জীবনে এই পয়লা ঢাকা শহর দেখতে গ্যাছে। এইডা কী কম আনন্দের কথা! আমি তো এই বয়সে আমাগো শহরই দেখি নাই।
- ঠিকই তো কইছ। তাছাড়া তোমার ভাই আছে বইলাই তো সুযোগটা পাইছে। ক’জনার সেই সুযোগ আছে।
- এইটা বাবু ঠিক কইছেন। আমি লেহাপড়া না কইরতে পারি। ভাইটারে লেখাপড়া শিখাইতে পাইরা বড় ভালা লাগছে। ঢাকা ইনিভার্সিটিতে পড়ে। কত বিদ্বান হইছে। অথচ অহনও বাড়ি আইলে পায়ে হাত দিয়া আমারে সালাম করে। অর ভাবীরে সালাম করে। গর্বে আমার বুকটা ভইরা যায় বাবু।
- দেখবা তোমার পোলাটাও ওর চাচার মত অনেক বড় হইবো। লেখাপড়া শিখবো।
- আমি চাষা-ভূষা মানুষ বাবু। পোলাটারে মানুষ করতে পারলেই আমার শান্তি। আজ ক’দিন ধইরা পোলাটা ঘরে নাই। মনটাও কেমন করছে। তাই ভাবলাম আপনেরে দিয়া একখান চিঠি লেখাইয়া দেই। যাতে তাড়াতাড়ি ফিইরা আসে।
বিভূতি বাবু পুরু মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা পরে নিলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে টিটোনি কলমটি বের করলেন। একটা সাদা কাগজের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে বললেন, - বল কী লিখতে হবে। ঢাকা শহরের অবস্থা কিন্তু বেশি ভালা না। সারা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হইছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ সব এলাকা পুলিশ ঘিইরা রাখছে। পাঁচ জনের বেশি লোকরে একলগে দেখলেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে নাকি গুলি করারও হুকুম জারি করছে সরকার।
- এ আপনি কী কন? দেশের আবার কী হইছে? এইতো কয়দিন আগে দেশ ভাগ হইলো। অহন আবার কি আলামত শুনতাছি! বিস্ময় প্রকাশ করে রহমত।
- কী আর হইবো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিছে। কইছে উর্দু-ই হইবো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমাগো পূর্ব পাকিস্তানিরা হেইডা মাইনতে নারাজ। আচ্ছা তুমি কও, আমরা মানুম ক্যান? বাংলা আমাগো মাতৃভাষা। উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তাইলে আমাগো পূর্ব পাকিস্তানিদের হাল চাষ করন ছাড়া কিছুই করন থাকবো না।
- উত্তেজিত হয়ে উঠে রহমত। না না এইডা ক্যামনে সম্ভব? বাংলা আমাগো ভাষা। আমরা বাংলায় চিঠি লিখি। বাংলায় কথা কই, গান গায়। খামাকা আবার উর্দু শিখতে যামু ক্যান।
বিভূতি বাবু প্লাস্টিক টিউব বের করে দোয়াত থেকে কলমে কালি ভরে নিলেন। কলমটা ঝেড়ে নিভ পরিষ্কার করলেন। হাতগুটিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন- এইতো গত ৩১শে জানুয়ারি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রিয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠন করা হইছে। তারা ২১-শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল, সভা-সমাবেশ ও মিছিলসহ বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। অথচ ঐ দিনই ১৪৪ ধারা জারি করছে সরকার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
- ঐ দিন, কি যে হয় ভগবানই জানেন। বল, তোমার চিঠিতে কি লিখতে হইবো কও।
- বাবু আপনে একটু ভালো কইরা লিখে দেন, যেন অরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিইরা আসে। আমি আর কি কমু। আমার সারা শরীর কাঁপতাছে। আপনে আপনের ভাইরে যেভাবে লিখতেন, আপনের পোলারে যেভাবে লিখতেন ঠিক সেভাবেই লিইখা দ্যান। আর চিডিটা যেন তাড়াতাড়ি পায় হেই ব্যবস্থা করেন বাবু।
শহিদুল চিঠিটা হাতে পেয়ে খুশী হয়। ইউনিভার্সিটির সামান্য দূরে ছোট এক রুমের বাসা। সাব-লেট নিয়ে থাকে। বাংলায় অনার্স করছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। টিউশনি করে। তাতে নিজের হাত খরচটা উঠে আসে। বাড়ি থেকে আসার সময় বড় ভাইজান জোর করে চাল দিয়ে দেয়। শহিদুল আনতে চায় না। তাতে রাগ করে রহমত। যতটুকু সম্ভব কিছু টাকা হাতে দিয়ে বলে- তোর কিছু ভাবতে হইবো না। শুধু মন দিয়া লেখাপড়া করবি। আর অনেক বড় মানুষ হবি। পারলে তো ত’রে আমার কইলজাটায় দিয়া দিই। হেই তৌফিক তো আল্লাহ আমারে দেয় নাইরে ভাই।
অহি খাটের উপর বসে একা একা লুডু খেলছিল। এতক্ষণ পাশের বাসার সাকিব ছিল। অহির সমবয়সী। নয় দশ বছর বয়স। অহির সাথে খুব ভালো ভাব হয়েছে। গ-গোলের জন্য স্কুল বন্ধ। তাই অহির সাথে সাকিবের সময়টা ভালোই কাটছে। চাচাকে একটা বড় থলে আর হাতে অনেকগুলো কাগজ নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল-
- ও চাচা, এত কাগজপত্র দিয়া কী করবা? মেলা বাজার নিয়া আইছ। খাইবো কেডা।
- আপনি বুঝবেন না অহিউল্লাহ সাহেব। এই নেন আপনের বাপ জানের চিঠি। দেখি কি লিখেছে একটু পড়ে শোনানতো।
অহি অতসব জিনিষের কথা ভুলে যায়। তাড়াতাড়ি বাবার চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল- ওমা এতো আমাগো পোস্ট মাস্টারের হাতের লেখা। বা’জান বুঝি তাড়াতাড়ি যাইবার কইছে। পরী বু কেমন আছে। আমার ঘুড়ি খান মায় ঠিকঠাক রাখছে কী না কে জানে?
- সব ঠিক আছে? কই, চিঠিটা পড়ে শোনাইলি না।
- আমি এত টানা হাতের লেখা পড়তে পারি নাকি? ও চাচা, আপনে বলেন না কী লিখছে?
- লিখছে, আমাগো লাইগা ত’র মা বাবার খুব খারাপ লাগতাছে। কইছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য।
- আমরা কখন যামু চাচা।
- আর ক’টা দিন পরেই যাবো বাপ। দেখছস না আমার উপর কত দায়িত্ব। কত সব কাগজপত্র। কত কাজ।
- এত সব কাগজপত্র দিয়া তোমার কী কাম। তুমি ত খালি বই খাতা নিয়া লেহাপড়া কর।
শহিদুল অহির মাথায় হাত রাখে। আদর করে পাশে বসিয়ে বলে-
- না রে বাপ। এগুলা হইলো দ্যাশের কাম। বাংলা আমাগো মাতৃভাষা। আর এই বাংলা ভাষাডারে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য শহরে খুব গ-গোল চলতাছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাগো মিছিল মিটিং হইবো। ঐ মিটিং-এর আগে আমাকে একশ’টা পোস্টার লিখতে হইবো। এইডা আমাগো অহন অনেক বড় কাম।
অহির মাথায় কিছুই আসছে না। রাষ্ট্রভাষা, মাতৃভাষা, গ-গোল কিছুই মিলাতে পারছে না। জিজ্ঞাসা করে, অচ্ছা চাচা মাতৃভাষা কী।
- দূর বোকা। তাও জানস না। এই যে, অহন আমরা যেমন আমাগো ভাষায় কথা বলছি, সেটাই আমাগো মাতৃভাষা। না, হাতে আর বেশি সময় নাই। কাইল বাদে পরশু ২১ তারিখ। পোস্টারগুলা লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে লাগাইতে হইবো। তাড়াতাড়ি দুইটা ডিম আর ভাত রান্না কইরা লই। সারারাত জাইগা এগুলো সব লিখতে হইবো।
- আইজ আর রান্না করতে হইবো না। সাকিবদের বাসায় আমাগো দুইজনরে দাওয়াত দিছে।
- তাইলে তো ভালোই হইলো। লেখার কাজটা শুরু কইরা দিই। তুই একটা লিখবি না কি?
- আমি কী তোমার মত সোন্দর কইরা লিখতে পারুম। আমি তোমার লগে বইসা বইসা দেহি।
অহি অনেক রাত জেগে চাচার সাথে বসে দেখল কিভাবে পোস্টার লিখতে হয়। চাচা একের পর এক রং তুলি দিয়ে পোস্টার লিখে যাচ্ছে। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’ মরি বাংলা ভাষা’। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আরও কত স্লোগান। অহি বসে বসে দেখছে আর চাচাকে মাঝে মধ্যে রং তুলি আর কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে। ঘুমে ঢুলু ঢুলু করছে চোখ। তবুও বসে আছে। শহিদুল বলল, তুই ঘুমাইয়া পড়। ছোট্ট অহি বলল, চাচা আর একটু দেহি। শহিদুল একটা লেখা পোস্টার দিয়ে বলল, ল’ এইটা দেইখা দেইখা লাল রং দিয়া তুই একটা লেখ। অহি অনেক খুশি। যেন এটাই চাইছিল। অহিকে চাচা দেখিয়ে দিল তুলি কিভাবে ধরতে হবে। অহি ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লিখল ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা’। শহিদুল দেখে বলল, বাহ! খুব সুন্দর হইছে তো। এইডা তুই রাইখা দে। এইবার আরেকটা লেখ।
কাক ডাকা ভোরে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে শহিদুল। বন্ধুদেরকে পৌঁছাতে হবে। কাল ২১শে ফেব্রুয়ারি। আজ রাতের মধ্যে সবাই মিলে পোস্টার লাগাবে। এর মধ্যে সাকিব এসে অহিকে জাগিয়ে দিল। তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। দুপুরে একবার এসে আবার বেরিয়ে পড়ল শহিদুল। বলে গেল, ফিরতে রাত হবে। বাইরে যেন কোথাও বের না হয়। রাতে যখন ফিরেছে তখন অহি ঘুমিয়েছে। পোস্টারটা বালিশের নিচে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছে অহি। বলেছে, ওইডা আমি বাড়িতে নিয়া যামু। ফিরতি চিঠিতে শহিদুলও ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে, এখন শহরের পরিস্থিতি ভালো না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আমি অহিকে নিয়ে ফিরে আসবো।
রহমত মিয়া ক্ষেতে মরিচের সারিগুলো দেখছে। চিকন লিকলিকে নুইয়ে পড়া মরিচের চারাগুলো আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বেগুন চারাগুলোও কেমন তরতাজা হয়ে উঠছে। এবার একটু পানি দিতে হবে। সুযোগ পেলেই পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নেয়। বিভূতি বাবুর কাছ থেকে ঢাকার খবরাখবর জেনে আসে। চিঠি আসে না। রহমত আলীর ভয় আরও বেড়ে যায়। যখন শুনে সমস্ত ছাত্ররা এই আন্দোলনে শরিক হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে।
আজ খুব ভোরে বেরিয়ে পরেছে শহিদুল। রাতে ঘুমাতে এসে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। আর অহি ঘুমের ঘোরে বার বার বলছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই--মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা। শহিদুল অবাক হয়ে স্পষ্ট শুনছে। অহির কপালে একটা চুমু দিয়ে আদর করে।
শীতের কুয়াশা কাটতে না কাটতেই সারা শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। অহি ভয়ে অস্থির। চাচা এখনও ফিরে আসেনি। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। দুপুরের পর আবার চারিদিকে মিছিল। অহি নিজের হাতের লেখাটা বুক পকেটে ভাঁজ করে রাখে। চাচার হাতে লেখা পোস্টারগুলো দেখবে বলে একা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ভয়ও হচ্ছে। বড় রাস্তাটা বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। সাকিবের সাথে বড় রাস্তায় এসেছে অনেকবার। আবার ফিরেও গেছে।
অনেকগুলো লোক শহিদুলের লেখা ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনগুলো উঁচিয়ে ধরে স্লোগান দিচ্ছে। হঠাৎ চারিদিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলির শব্দে লোকজন দিগ¦বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকেই মারা গেল গুলিতে। একসময় সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
পরদিন সকালে খবরের কাগজে অনেক শহিদের আত্মত্যাগের কথা ছাপা হলো। তারই মাঝে একটা সংবাদ ছাপা হলো যে, এই সংগ্রামে অহিউল্লাহ নামে দশ এগারো বছরের একজন কিশোর প্রাণ হারিয়েছে। মৃত্যুর আগে সে বার বার বলছিল, ‘বা’জান আমার ঘুড়িটা পরী’বু-রে দিয়া উড়াইয়া দিও’।
মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৭
ঘুড়ি - মিলন বনিক
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
Post Top Ad
Author Details
গল্প পড়তে বা শুনতে কে না ভালোবাসে,সেই ছোট্ট বেলায় দাদির কোলে,নানির কোলে, বা অন্য কারো কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বা চোখ কান খাড়া করে, বৃষ্টি বা শীতের রাতে খাতা মুরি দিয়ে অথবা চাঁদনি রাতে উঠোনে বা ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প কিচ্ছা শুনেনি এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
HELLO! VISITOR