চাদর - মিলন বনিক - bangla story

ads

test banner Web hosting

সর্বশেষ পোস্টকৃত গল্প

Post Top Ad

test banner

Post Top Ad

infaj banner

সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭

চাদর - মিলন বনিক

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ।
অর্নব বায়না ধরেছে। বড় মামার সাথে বেড়াতে যাবে। ছোট মামা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। একমাত্র ভরসা বড় মামা। বাড়ি আর ব্যবসা। যেন তেন ব্যবসা নয়। বড় একটা বইয়ের দোকান। হরেক রকমের বই তাকে তাকে সাজানো। অর্নবের ধারনা বড় মামার অনেক বিদ্যা বুদ্ধি। এত্তো এত্তো বই। আচ্ছা, মামা অবসর সময়ে কি করে? নিশ্চয় বই পড়ে। কত রকমের বই! যখন যেটা ইচ্ছা সেটা পড়তে পারে। অর্ণব তা পারে না। এবার মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে যাবে। মাঝে মধ্যে মামা শহরে এলে অর্নবের জন্য দু’একটা বই নিয়ে আসে। টিন টিনের বই, কমিকসের বই। জাফর ইকবালের বই। পড়তে বেশ লাগে।

বেশ শীত পড়ছে। শহরে শীতটা একটু কম। গ্রামে সারাদিন যেন শীতটা জেঁকে বসে। আজ বৃহস্পতিবার। মামার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। মামা প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছে, দোকানে তুই কীভাবে থাকবি? অর্নব বলেছে, আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো। 

বছরের প্রথমে বই কেনার ধুম। মামা বই নিতে আসবে আন্দরকিল্লা। যাওয়ার সময় অর্নবকে নিয়ে যাবে। মামা দোকানে প্রয়োজনীয় বইয়ের অর্ডার করে অর্নবকে আনতে যায়। অর্নব ততক্ষণে তৈরী। কাল শুক্রবার। বিকালে দোকান বন্ধ করে মামার সাথে বাড়ি নিয়ে যাবে। অর্নবের খুশি আর ধরে না। শীতের রাতে কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে গাড়ি করে যাবে। এ যেন টিন টিনের লাল বোম্বেটে গুপ্তধনের মত বিশাল এক এ্যাডভেঞ্চার। রাতের আকাশে কুয়াশার চাদরে ঢাকা কর্ণফুলী নদী কখনও দেখা হয়নি। এই প্রথম দেখবে। 

রাত এগারটা বাজে। আন্দরকিল্লা থেকে পুরো এক টেম্পো বই নিয়ে গাড়ি ছেড়েছে। ঠিক অর্নবের সমবয়সী একটা ছেলে বইগুলো টেম্পোর ভিতর গুছিয়ে দিচ্ছে। টেম্পোর পেছনে দু’জন কোনভাবে চাপাচাপি করে বসতে পেরেছে। আর সব কেবল বই আর বই। অর্নব বুক ভরে নতুন বইয়ের গন্ধ নিচ্ছে আর বার বার হাত বুলিয়ে দেখছে। টেম্পোর পাটাতনে একটুখানি জায়গায় ছেলেটা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে।

টেম্পো শহরের কোলাহল ছেড়ে বের হতেই ড্রাইভার জোড়ে হাঁক দিল-ঐ রফিক্ক্যা, তুই কি ঘুমাইছস। গাড়ির ডানে বাঁয়ে কি আমি দেইখ্যা চালামু। ছেলেটির নাম রফিক। জবুথবু হয়ে বলল-না ওস্তাদ ঘুমায় নাই। গাড়ি বহদ্দার হাট পার করছে। সে আর কোনভাবেই দাড়াতে পারছে না।

হ্যাংলা পাতলা রোগা শরীর। গায়ে হলুদ রংয়ের ময়লা হাফ শার্ট। পরনে হাফ প্যান্ট। খালি পা। রাতের শহরের কোলাহল ছেড়ে বাইরে তেমন মানুষজন নেই। গাড়ি চলাচলও কম। প্রচন্ড ঠান্ডা। গাড়ি যত এগুচ্ছে শীত তত বাড়ছে। অর্নব খেয়াল করল রফিক কাঁপছে। অর্নবের গায়ে জ্যাকেট। মাথায় উলের টুপি। কান পর্যন্ত ঢাকা। পায়ে মৌজা ও কেডস। জিনসের লম্বা প্যান্ট। তারপরও যেন ঠান্ডা কমছে না। মামার মাথায় টুপি থাকা সত্বেও কাশ্মিরী চাদরটা দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। কনকনে ঠান্ডা। মামা অর্নবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল-তোকে বল্লাম, না আসতে। এবার মজা টের পাচ্ছিস তো। ঠান্ডা কেমন লাগছে? অর্নব কিছুই বলল না। কেবল রফিকের দিকে তাকিয়ে আছে। আর খেয়াল করছে রফিক একটু একটু করে সরে গিয়ে মামার দু’পায়ের মাঝখানে চাদরের সাথে গা লাগিয়ে হাত দু’টো বগলের নীচে জোরে চেপে ধরেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ঠক্ ঠক্ শব্দ করছে। পা দু’টো ভীষণ কাঁপছে। অর্নব ভয় পাচ্ছে। সে ডিসকভারিতে দেখেছে, এরকম ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়া কিংবা নিমোনিয়া হয়ে মানুষ মারাও যেতে পারে।

মামা চাদরের একটা অংশ দিয়ে রফিকের পা মাথা ঢেকে আর একটু চেপে বসতে বলল। রফিক তাই করল। একটু উম পেয়ে চোখ মেলে তাকাল অর্নবের দিকে। ততক্ষণে গাড়ি কালুরঘাট ব্রীজের কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্নব জিজ্ঞাসা করল-
- তোমার বাড়ি কোথায়।
- নোয়াখালী।
- মা বাবা নেই। 
- বাবা নাই। মা আছে।
- বাবা কই। 
- জানি না। 
- মারা গেছে। 
- তাও জানি না। 
- রাতে কোথায় থাক।
- গ্যারেজে।

ততক্ষণে রফিকের নাক দিয়ে অনবরত সিঁ ঝরছে। একবার চাদর থেকে সরে গিয়ে নাক ঝেড়ে নিল। আবার চাদরের ভিতর ঢুকে মামার কোলে মাথা রাখল। মামা রফিকের মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলল-নে ঘুমিয়ে পড়। 

মামা অর্নবকে বলল-এই দেখ কর্ণফুলী নদী। গাড়ি এখন ব্রীজের উপর উঠে গেছে। সমান্তরাল রেল লাইনের উপর দিয়ে চলছে গাড়ি। নদীর জল দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঘন কুয়াশা। নদীর জলে কয়েকটা হারিকেনের আলো মিটি মিটি করে জ্বলছে। অর্নব জিজ্ঞাসা করল-মামা পানিতে আলো কিসের। মামা বলল-ওরা নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। অর্নবের ভয় হচ্ছে গাড়িটা যদি নীচে পড়ে যায়। তবে সব বই ভিজে যাবে। কেউ বাঁচবে না। গাড়ি এবার ব্রীজ পার হয়ে নীচের দিকে নামছে। এতক্ষন ভয়ে বুক কাঁপছিল। এবার কথা বলল অর্নব-মামা ওদের শীত লাগে না। মামা বলল-অভ্যাস হয়ে গেছে। মাছ না ধরলে খাবে কী? এই যেমন আমরা এত রাতে কষ্ট করে বই নিয়ে যাচ্ছি। কাল বিক্রি করব। লাভ হবে। কষ্ট না করলে ব্যবসা হবে না। জীবনে এমনি এমনি কিছু হয় না। 

রফিক এবার মাথা তুলে বলল, হ মামা. ঠিক কইছেন। আমি মেলা কষ্ট করি। কুন বেলা পেটভইরা খায়। কুন বেলা না খাইয়া থাকি। তবুও এক টেহা দুই টেহা কইরা জমাইয়া মা’র হাতে দিই। মায়েরে কইছি-বড় হইলে একটা টেম্পু কিনুম। আর আমি নিজে ড্রাইভার হইয়া হেইডা চালামু।
- লেখাপড়া কর না কেন।
- কেমনে করুম। আমি কাম না করলে মায় খাইবো কী? 

অর্নবের খুব কষ্ট হচ্ছে। তারই সমবয়সী একটা ছেলে। এই হাড় কাঁপানো শীতে কী কষ্টটায় না পাচ্ছে? অথচ আমরা খেয়ে দেয়ে দিব্যি আরামে স্কুলে যাচ্ছি। এই রফিকেরও তো স্কুলে যাওয়ার বয়স। অর্নব নিজের সাথে রফিকের কোন হিসাব মিলাতে পারছে না।

গাড়ি গোমদন্ডী ফুলতলায় লাইব্রেরির সামনে এসে দাড়িয়েছে। ড্রাইভার ষ্টার্ট বন্ধ করে ডাকছে-ঐ রফিক্ক্যা। সারা রাস্তা ঘুমাইছস। তাড়াতাড়ি মাল নামাইয়া দে। আমি আইতাছি। রফিক তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামল। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রচন্ড কাঁপছে। গরম কম্বলের ভিতর থেকে হঠাৎ খালি গায়ে হিম শীতল ঠান্ডায় আসলে যেমন হয় ঠিক তেমন। কুয়াশার চাদরে মোড়া মফস্বল শহরের বিদ্যুতের আলোগুলোকে কাছে থেকেও ঝাপসা দেখাচ্ছে। মামা রফিকের গা থেকে চাদরটা সরিয়ে নিতেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল। একবার অর্নবের দিকে একবার মামার দিকে। তারপর তড়িঘড়ি বই নামানোর কাজে হাত দেয়। কিন্তু পারছে না। খালি পা মাটিতে লাগার সাথে সাথে থির থির করে কাঁপছে। এবার মামা আর অর্নব চুপ করে থাকতে পারে নি। তারাও হাত লাগায়। দ্রুত বই নামানো শেষ হয়। ড্রাইভার এখনও আসেনি। রফিক গাড়ির পেছনের সীটে হাত পা মাথা এক করে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। ঠান্ডায় সারা শরীর বরফ হয়ে যাচ্ছে। 

অর্নব দোকানের সামনে দাড়িয়ে দেখছে রফিককে। তার খুব মায়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। একবার মামাকে বলতে চাইল, তোমার তো দু’টো চাদর। একটা রফিককে দিয়ে দাওনা। বলতে পারল না। ততক্ষনে ড্রাইবার এসে গেছে। গাড়ি ষ্টার্ট করেছে। এখনি চলে যাবে। মামা তাড়াতাড়ি দোকানের বাইরে এসে রফিকের গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল-এটা তোর জন্য। বেশী ঠান্ডা লাগাবি না, অসুখ করবে। 

গাড়ি টান দিতেই অর্নব হাত নেড়ে রফিককে বিদায় দিল। মামার দিকে তাকিয়ে বলল-মামা তুমি খুব ভালো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

HELLO! VISITOR

Post Top Ad

test banner