অদ্ভুত হত্যা - bangla story

ads

test banner Web hosting

সর্বশেষ পোস্টকৃত গল্প

Post Top Ad

test banner

Post Top Ad

infaj banner

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

অদ্ভুত হত্যা





কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করিবার অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির সম্বন্ধে বিশেষ অনুসন্ধানের নিমিত্তে আমাকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে যাইতে হইয়াছিল। প্রায় সপ্তাহকাল সেখানে সে মোকদ্দমার যথাসম্ভব প্রমাণাদি সংগ্রহ করিয়া গোয়ালনন্দ-ট্রেনে রাত্রে কলিকাতা প্রত্যাবর্তন করি। পরদিন প্রাতঃকালে কাগজপত্র গুছাইয়া রিপোর্টাদি লিখিয়া নিজের প্রয়োজন বশতঃ জনৈক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্ করিতে যাইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময়ে একজন কনেস্টবল যথারীতি লম্বা সেলাম ঠুকিয়া, একখানা সরকারী চিঠি আমার হস্তে প্রদান করিল। চিঠির উপরে লাল কালিতে বড় বড় ইংরেজী অক্ষরে লিখিত 'অতি দরকারী ' - এই দুটি কথা সর্ব প্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কনেস্টবলকে বিশ্রাম ঘর দেখাইয়া দিয়া ত্রস্ত হস্তে চিঠি খুলিয়া পত্র পড়িতে লাগিলাম। পত্রে প্রধান কর্মচারী যাহা লিখিয়া পাঠাইয়াছেন, তাহার সারমর্ম এই -
' আজ চারি দিবস গত হইল, মির্জাপুর স্ট্রীটের একটি ছাত্রাবাসে মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি ছাত্র অতি আশ্চর্যরূপে হত হইয়াছে। পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও এ পর্যন্ত খুনের কিনারা করিতে পারে নাই। তুমি মুহূর্তমাত্র গৌণ না করিয়া উক্ত হত্যার ব্যাপারে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে। মুচিপাড়া থানার পুলিশ কর্মচারী হত্যা ব্যাপারে প্রথম অনুসন্ধান করিয়াছে।'
পত্রখানি পাঠ করিয়া আমার বন্ধুদর্শনবাসনা পলকে বিলুপ্ত হইল। সেই কৃত্রিম মুদ্রার জটিল মোকদ্দমার গুরুভার হইতে মুক্ত হইতে না হইতেই আবার এক হত্যা কাণ্ডের গুরুতর ভার মস্তকে বহন করিতে হইবে ভাবিয়া মন অবসন্ন হইয়া পড়িল। কিন্তু ঊর্ধতন কর্মচারীর আদেশ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে , সুতরাং আর ইতস্ততঃ না করিয়া কনেষ্ট্বলকে বিদায় দিয়া গাড়োয়ানকে গাড়ি প্রস্তুত করিতে আদেশ করিলাম এবং কিঞ্চিত্ জলযোগান্তে অবিলম্বে মুচিপাড়া থানায় উপস্থিত হইলাম। সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে বড়সাহেবের লিখিত পত্রের মর্ম জ্ঞাত করাইলে তিনি আমাকে উক্ত হত্যা ব্যাপারের প্রধান অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করাইয়া দিলেন। অনুসন্ধানকারী কর্মচারীর নাম সুশীলবাবু; সুশীলবাবু আমার পূর্বপরিচিত। ইনি আমাকে হত্যা সম্পর্কে নিজ তদন্তে যতদূর তথ্য সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা একে একে সন্তুষ্টির সহিত বর্ণনা করিলেন। হত্যা সংক্রান্ত আমূল বিবরণ শুনিয়া আমি বুঝিতে পারিলাম, এ ব্যাপারের কিনারা করা সহজ-সাধ্য নহে পুলিশানুসন্ধানে এ সম্বন্ধে যতদূর জানা গিয়াছে, তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রকটিত হইল:
"মহেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি বিক্রমপুর অঞ্চলের বজ্রযোগিনী গ্রামে। ইঁহার পিতার নাম, ঁহরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। মহেশ কলকাতার সিটি কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করিতেন। মির্জাপুরে এক স্টুডেণ্ট মেসে ইঁহার বাস ছিল। ঁশ্রীশ্রী দুর্গা পূজার বন্ধে সেই মেসের অধিকাংশ ছাত্রই বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল, কেবল তিনজন বি.এ পরীক্ষার্থীর সহিত মহেশচন্দ্র বন্ধের সময়েও সেই মেসেই ছিলেন। মেসের বাড়িটা দ্বিতল; উপরের চারটি ঘর, নীচে দুটি। মেসে অধিক ছাত্র না থাকায়, পড়াশুনোর সুবিধার নিমিত্ত চারিটি ঘরে চারিজন ছাত্র শুইবার বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছিলেন। নীচের একটি ঘরে রান্না ও অপরটিতে খাওয়া-দাওয়ার কার্য সম্পন্ন হইত। মেসে এখন একটি মাত্র ব্রাহ্মণ দ্বারাই সর্ব কার্য চালিত হয়। ব্রাহ্মণটি রাত্রে মেসে থাকে না। ২৬শে আশ্বিন রাত্রিতে, মহেশচন্দ্রকে অন্যান্য রাত্রির ন্যায় সবাই সুস্থ শরীরে আপন ঘরে পড়িতে দেখিয়াছেন। পর দিবসে প্রত্যুষে অতুলবাবু নামে ঐ মেসেরই অন্যতম ছাত্র যখন মহেশচন্দ্রে ঘরের মধ্য দিয়ে নিম্নতলে যাইতেছিলেন, তখন তাহাকে ছিন্ন-কণ্ঠ, রক্তাক্ত কলেবর দেখিতে পাইয়া উচ্চ চিত্কারে সবাইকে একত্র করেন। পরে, তথায় উপস্থিত সকলের সঙ্গে পরামর্শ-মত অগৌণে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ অনুসন্ধান করিয়া সে ঘরে রক্তরঞ্জিত বড় কাটারি ও একপাটি নাগরা জুতো প্রাপ্ত হইয়াছেন। এগুলি ইতিপূর্বে মেসের কেহ কখনো দেখে নাই। হত্যাকারীর এ পর্যন্ত কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আশ্চর্যের বিষয়, হত্যাগৃহের একটি সামান্য জিনিস কিম্বা একটি কর্পদ্দকও স্থানান্তর হয় নাই। মহেশের চাবি তাহার পকেটে পাওয়া গিয়াছে; উক্ত চাবি দ্বারা পুলিশ মহেশের পোর্টমেণ্ট ও হাতবাক্স খুলিয়া টাকা পয়সা মহেশের লিখিত হিসেবের মিল মতই পাইয়াছেন।
মহেশের সহিত যে সে মেসে কাহারও মনোমালিন্য বা বিবাদ ছিল, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনটি ছাত্র ও ব্রাহ্মণের জবানবন্দী-তে হত্যার অনুসন্ধানে কার্যকরী হইতে পারে, এরূপ কোন কথাই প্রকাশ পায় না। ইঁহাদের কেহ কাহাকে মহেশের হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন না। পরন্তু মহেশের সহিত সকলেরই সদ্ভাব ছিল বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যায়।"
পুলিশের এই রিপোর্ট দেখিয়া এবং ব্রাহ্মণ ও ছাত্রত্রয়ের জবানব্ন্দী আনুপূর্বিক মনোযোগ সহকারে পাঠ করিয়া অনুসন্ধানের কোন সূত্রই বাহির করিত পারিলাম না। তবে জুতো ও কাটারিখানা দেখিতে হইল। সুশীলবাবু তত্ক্ষণাত্ সেগুলি আমার সমক্ষে উপস্থিত করিলেন। আমি তখন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পাইলাম, রক্তাক্ত কাটারিখানা অপূর্ব-ব্যবহৃত। জুতাখানিও একেবারে অব্যবহৃত বলিয়াই বোধ হইল। উহা পায়ে দেওয়ার কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হইল না। সুতরাং আমি সেখানে আর বেশী সময় অপেক্ষা না করিয়া সেই মেসটি দেখিতে মনস্থ করিলাম এবং সুশীলবাবুর সহিত সেই মেসে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
তখন পুজো উপলক্ষে স্কুল কলেজাদি বন্ধ ছিল, সুতরাং সকলকে বাসায় প্রাপ্ত হওয়া গেল। আমি প্রথমে হত্যাগৃহ এবং তত্পরে মেসের অন্যান্য স্থান যথারীতি পরীক্ষা করিলাম; কিন্তু হত্যা সম্বন্ধে কোন নূতন তথ্যই সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলাম না। পরিশেষে আমি হত্যাগৃহে প্রথম উপস্থিত সেই অতুলবাবুকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং উত্তর আমার নোট-বহিতে লিখিয়া লইলাম।
আমি: আপনি সেদিন প্রাতেই প্রথম সে কক্ষে পদর্পণ করিয়াছিলেন, না, রাত্রে সে কক্ষের ভিতর দিয়া আর কোন বার নীচে নামিয়া ছিলেন?
অতুলবাবু (অ.ববু): না, সেই প্রথম আমি সে কক্ষে প্রবেশ করি।
আমি: যে রাত্রে মহেশ খুন হয়, সে রাত্রে সর্বশেষ তাহাকে কে জীবিত দেখিয়াছিলেন?
অ.বাবু: সর্বশেষ কে জীবিত দেখিয়াছিলেন মনে নাই। আমরা সকলেই একসঙ্গে নীচের ঘর হইতে উপরে আসিয়া আপন আপন কক্ষে পড়িতে বসিয়াছিলাম।
আমি: আপনারা সেদিন শয়ন করিবার পূর্বে আর নীচে যান নাই?
অ.বাবু: আমি সেদিন আর নীচে যাই নাই।
আমি তখন আর দুজনকে এ প্রশ্ন জিজ্ঞসা করিলাম, তাঁহারা তদুত্তরে বলিলেন, সে রাত্রে তাঁহাদের কাহারও নীচে যাইবার প্রয়োজন হয় নাই। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলম -
'আপনাদের মেসের ছাত্রগণ ব্যতীত আর কাহারও সাথে মহেশবাবুর বিশেষ জানাশুনো ছিল বলিয়া আপনারা জানেন?
অ.বাবু: মহেশবাবুর বিশেষ বন্ধু ত কেহ দেখিতে পাই না।
আমি: মহেশবাবুর কাহারও সহিত শত্রুতা বা মনোবিবাদ ছিল, বলিতে পারেন?
অ.বাবু: না মহাশয়, তাহার সহিত কাহারও শত্রুতার কথা আমরা পরিজ্ঞাত নহি।
আমি: হত্যার দিনে মহেশবাবু সমস্ত দিবস কি মেসে ছিলেন, না কোথাও বাহির হইয়াছিলেন?
অ.বাবু: (খানিক চিন্তার পর) হঁযা, মহেশবাবু সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে বাহিরে গিয়াছিলেন।
আমি: কোথায় গিয়াছিলেন, বলিতে পারেন?
অ.বাবু: না, তাহা বলিতে পারি না।
আমি: মহেশবাবুর কি বেড়াইবার অভ্যাস ছিলো?
অ.বাবু: মধ্য মধ্যে বেড়াইতে যাইতেন বৈকি।
আমি: হত্যার তারিখে কোন সময়ে বাসায় প্রত্যাবর্তন করেন?
অ.বাবু: বোধহয় রাত্রি সাড়ে ৭টা, কি ৮টার সময়।
আমি: মহেশবাবুর স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল, আপনার বিশ্বাস?
অ.বাবু: (একটু বিরক্তির সঙ্গে) ওগুলো কি বলিব?
আমি তখন অপেক্ষাকৃত গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলাম, 'দেখুন, আপনারা সকলেই বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। অবশ্য বুঝিতে পারিতেছেন, এ হত্যার কিনারা করা বড় সহজসাধ্য নহে। কেহ অর্থলোভে এ নৃশংস কাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছে, অবস্থা পর্যবেক্ষণে , এমন বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। ঈর্ষামূলেই বোধহয় এ লোমহর্ষক হত্যা সংশাধিত হইয়াছে। এক্ষণে যদি আমি হত ব্যক্তির সম্বন্ধে কথা অবগত হইতে না পারি, তবে প্রকৃত দোষীর অনুসন্ধান কিরূপে করিতে সমর্থ হইব? আর অবশ্য ইহাও আপনারা বুঝিতে পারিতেছেন, যদি কোন প্রকারেই এ হত্যার কূলকিনারা করা না যায়, তবে পুলিশ শেষকালে আপনাদের লইয়াই টানাহিঁচড়া করিতে পারে। কে জানে আপনারা কেহ এ ব্যাপারে বিজড়িত নহেন? এ বাড়িতে অপর কেহ বাস করে না, মহেশবাবুর সহিত অন্য কাহারও শত্রুতা ছিল না, এ কথা আপনারাই বলিতেছেন, এমত অবস্থায় কাহার উপর সন্দেহ দৃষ্টি পড়িতে পারে, তাহা আপনারাই ভাবিয়া দেখুন। হত্যাগৃহে প্রাপ্ত কাটারিখানি সম্পূর্ণ নূতন, সুতরাং হত্যাকারী যে পুরাতন-পাপী নহে, ইহাই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে - একপাটি নাগরাজুতো পাওয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু কে বলিতে পারে ইহা আপনাদের চালাকি নয়? -
আমি এতদূর বলিলে ছাত্রবাবুটি অপেক্ষাকৃত কাতর স্বরে বলিলেন, 'ক্ষমা করুন মহাশয়, আমি যাহা জানি বলিতেছি। আমার বিশ্বাস মহেশবাবু নিষ্কলঙ্ক চরিত্র বলা যায় না।'
আমি: বামনটি কেমন, কতদিন যাবত্ এখানে কাজ করিতেছে?
অ.বাবু: অনেকদিন। বামনটি খুব বিশ্বাসী, সে আমাদের বড় যত্ন করে।
আমি: কাহার সঙ্গে, কোথায়, মহেশবাবুর আসা যাওয়া ছিল, বলিতে পারেন?
অ.বাবু: সে সম্বন্ধে কিছুই পরি না। তবে তিনি মধ্যে মধ্যে অনেক রাত্রির পর বাসায় আসিতেন এবং মাঝে মাঝে একটি ঝি শ্রেণীর স্ত্রীলোক তাহার সঙ্গে সাক্ষাত্ করিত।
আমি: ঝির ঠিকানা আপনি জানেন?
অ.বাবু: না, মহাশয়, ঠিকানা জানি না।
আমি: ঝিকে দেখিলে চিনিতে পারিবেন?
অ.বাবু: হঁযা, পারিব বৈকি। হত্যার তারিখেও দিনের বেলায় ঝি তাহার নিকট আসিয়াছিল।
আমি: যে দিন হত্যার কথা জানিতে পান, সেদিন প্রথমে কে সদর দরজা খুলিয়াছিলেন?
অ.ববু: সম্ভবত সদর দরজা খোলা ছিল।
আমি: সদর দরজার খিলান তো অভগ্ন; তবে হত্যা কিরূপে সংঘটিত হইল আপনাদের বিশ্বাস?
অ.বাবু: সদর সরজা মধ্য মধ্যে খোলাও থাকে, বোধহয় সে রাত্রে আমরা কেহ দরজা ভেজাই নাই।
----
মহেশের চরিত্র ভালো ছিল না, তবে কি অপর কোনও মন্দ-চরিত্র প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বারা এ কার্য সম্পন্ন হইয়াছে? অসম্ভব কি? কিন্তু সেই ব্যক্তির অনুসন্ধান কিরূপে করিব? মেসের কেহ ত কুচরিত্র নহে? সদর দরজার খিলান অভগ্ন; এমত অবস্থায় সহজে বাহিরের লোক কিরূপে ভিতরে প্রবেশ করিবে? কিন্তু যদি সদর দরজা সে রাত্রে খোলাই থাকে, তবে এই কথার উপর নির্ভর করিয়া মেসস্থ ছত্রদিগকে দোষী সাব্যস্ত করা ত যুক্তিযুক্ত নহে। আচ্ছা, একটা লোক একই বাড়িতে খুন হইল, আর বাড়ির অপর কেহ ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না, ইহা বা কি প্রকারের কথা? হত্যাগৃহে একখানা নাগরা জুতা প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তবে কী হত্যাকারী কোন হিন্দুস্থানী? কিন্তু তাহা হইলে জুতাখানি একেবারে অব্যবহৃত থাকিবার কারণ কি? এ জুতা পায়ে দেওয়া হইয়াছে বলিয়া ত কিছুতেই বোধ হয় না।
মেসের ছাত্র হইতে জানিলাম, একটি ঝি মহেশের কাছে যাওয়া আসা করিত, হত্যার তারিখেও আসিয়াছিল; সে ঝি কে? তাহার সন্ধানের উপায় কি? - এবম্বিধ নানা প্রশ্ন ক্রমে ক্রমে মনে উদিত ও লয়প্রাপ্ত হইতে লাগিল। শেষে যখন আর ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছু স্থির করিতে পারিলাম না; কোন সূত্রালম্বনে অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিব, তাহার কিছুই নির্দ্ধারণ করিতে সমর্থ হইলাম না; তখন অগত্যা তখনকার মত এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, রজনীযোগে গুপ্তভাবে মির্জাপুরের সেই ছাত্রাবসে ছাত্রদিগের কথাবার্তা শুনিতে চেষ্টা পাইব। যদি প্রকৃত প্রস্তাবে ইহারা হত্যা ব্যাপারে সংসৃষ্ট থাকে কিম্বা এ সম্বন্ধে কিছু পরিজ্ঞাত থাকে, তবে খুব সম্ভবতঃ ইহাদের মধ্যে আজ এ বিষয়ে গোপনীয় কথাবার্তা চলিতে পারে। তখন বোধহয় হত্যা সম্বন্ধে কিছু না কিছু সন্ধান পাইব।
এরূপ স্থির করিয়া স্নানাহার সমাপান্তে শয্যায় পড়িয়া একটু বিশ্রাম ভোগ করিতেছি, এমন সময়ে হঠাৎ মনে পড়িল, এ হত্যা সম্বন্ধে ডাক্তার সাহেব কি অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই। অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিবার পূর্বে এ তথ্যটি জানিয়া লওয়া আমার একান্ত কর্তব্য। এই মনে করিয়া তত্ক্ষণাত্ গাত্রোত্থান পূর্বক ধড়াচূড়া পরিধান করিয়া পুনরায় মুচিপাড়া থানা অভিমুখে রওনা হইলাম।
যথাকালে মুচিপাড়া থানায় পহুঁছিয়া সরকারি ডাক্তারের রিপোর্টটি পাঠে অবগত হইলাম, তাহাতে সন্দেহ আরও বর্দ্ধিত হইল। ডাক্তার বলেন, মৃত্যুর পূর্বে হত ব্যক্তিকে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে হতচেতন করা হইয়াছিল। পরে অজ্ঞান অবস্থায় তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতে ইহাকে হত্যা করা হইয়াছে। কি ভয়ানক কথা! জীবিতাবস্থায় হত্যা করিলে পাছে আহত ব্যক্তির আর্তনাদে অন্যান্য লোক জাগরিত হইয়া পড়ে, এজন্যে পূর্বাহ্নে সাবধান হইয়া হত্যাকারী ইহার উপর বিষ প্রয়োগ করিয়াছিল! হত্যাকারী তবে তো নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি নহে! মেসের কোন ছাত্র কি তাহা হইলে আন্তরিক বিদ্বেষ্বশে, গুপ্ত কারণে অপর সকলের অজ্ঞাতে এরূপ সাবধানতা সহকারে হত্যাকাণ্ড সমাধা করিল? সন্দেহ ক্রমে দৃঢ় হইতে লাগিল। এ সময়ে একবার মহেশের মৃত্দেহ দেখিতে ইচ্ছে হইল, কিন্তু সে সুবিধ ঘটিয়া উঠিল না। আমার কলিকাতা পহুঁছিবার বহুকাল পূর্বেই, ডাক্তারের পরীক্ষার পর উক্ত মৃতদেহের সত্কার হইয়া গিয়াছিল|।
নানা বিষয়িনী চিন্তার পর অবশেষে আমি প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মচারী সুশীলবাবুর সহিত পুনরায় সাক্ষাত্ করিলাম। এবং তাহাকে জিজ্ঞ্সা করিলাম, 'সুশীলবাবু, কি সূত্রে অনুসন্ধান কার্য আরম্ভ করিব?'
সুশীলবাবু হাসিয়া উত্তর করিলেন, 'সূত্র বাহির করিবার জন্যেইতো টিকটিকির প্রয়োজন। '
সুশীলবাবু ডিটেকটিভদের টিকটিকি বলিতেন। আমি পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, 'আপনি সেদিন ঘর তল্লাসের সময় কাহারও কাছে ক্লোরোফর্ম আছে কিনা অনুসন্ধান করিয়াছিলেন কি?'
সুশীল বলিলেন, 'আমরা তখন ত জানিতাম না যে হত ব্যক্তির ওপর প্রথমে ক্লোরোফর্ম প্রযুক্ত হইয়াছিল।'
আমি তখন হাসিয়া বলিলাম, ' অনুসন্ধানের সকল সুযোগ আমি কলিকাতা আসিবার পূর্বেই শেষ হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং এখন এ হত্যা সম্বন্ধে তদন্ত করিয়া কৃতকার্যতার আশা বিড়ম্ব্না মাত্র।'
ইহার উত্তরে সুশীলবাবু বলিলেন, ' ভাল মনে পড়িল - সেদিন মহেশচন্দ্রের হাতবাক্স অনুসন্ধানের সময় ইহার ভিতরের কতগুলি চিঠিপত্র আমি সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলাম, অবকাশভাবে সেগুলি এ পর্যন্ত পড়ি নাই। আপনার ইচ্ছে হইলে আপনি তাহা পড়িয়া দেখিতে পারেন, যদি কোন সূত্র বাহির হয়।' এই বলিয়া তিনি কতগুলি বিশৃঙ্খল চিঠিপত্র আনিয়া আমার সন্মুখস্থ টেবিলে ফেলিয়া চলিয়া গেলেন। আমিও তখন আর কিছু করিবার নাই ভাবিয়া সেগুলি হইতে এক একখানি পত্র লইয়া আগ্রহ সহকারে আপন-মনে পড়িতে লাগিলাম। পাঁচ সাত খানি চিঠির পর একখানি চিঠি পাঠ করিয়া আমি একেবারে চমকিয়া উঠিলাম।
( শেষ অংশের জন্যে এইখানে ক্লিক করুন)
রজনীচন্দ্র দত্ত
রজনীচন্দ্র দত্ত গ্রামের এক স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন। ১৩০৬ সালে কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছিলেন এই গল্পটি লিখে। অন্য কোনও রহস্যকাহিনী উনি লিখেছিলেন কিনা জানা যায় না। প্রসঙ্গত, কুন্তলীন পুরস্কারটি চালু করেন কুন্তলীন কেশতেল এবং দেলখোস এসেন্স প্রস্তুতকারক হেমেন্দ্রকুমার বসু। কুন্তলীন পুরস্কারের জন্য জমা দেওয়া গল্পে কুন্তলীন ও দেলখোসা এসেন্সের প্রসঙ্গটা গল্পের মধ্যেই যুত্সই কোনও জায়গায় উল্লেখ থাকতে হবে - এটাই ছিল শর্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

HELLO! VISITOR

Post Top Ad

test banner